শেষ চিঠি



ফারিয়া আমাকে ছেড়ে চলে গিয়েছে আরো আট বছর আগে। তার সাথে আমার রিলেশন প্রায়ই তিন বছরের। যখন ইন্টারের ১ম বর্ষে ভর্তি হই তখন থেকেই ফারিয়ার সাথে আমার পরিচয়। তবে তার সাথে পরিচয় হয়েছিলো গৃহ শিক্ষকের মাধ্যমে। দশম শ্রেণীতে যে স্যারের কাছে পড়তাম তার মেয়ের নাম ফারিয়া। স্যার আমাকে বাসায় এসে পড়াতেন। আর তখনও আমি জানতাম না তার মেয়ে আছে। এস.এস.সি. পরিক্ষার ফল আলহামদুলিল্লাহ্‌ ভালই এসেছিলো। ভাল একটা কলেজে ভর্তি হই। অনেক আশা ছিলো ছোট বেলায় যেনো ভাল একটা সরকারি কলেজে ভর্তি হতে পারি। সে ক্ষেত্রে সুযোগটা কাজে লেগে যায়। তো একদিন স্যার'কে কলেজে দেখতে পাই। এবং তার সামনে গিয়ে সালাম দেই। এবং জানতে চাইলাম কেনো এই কলেজে এসেছে। তো একটা পর্যায় স্যার তার মেয়ের সাথে আমাকে পরিচয় করিয়ে দিলেন।
.
অল্পদিনেই ফারিয়ার সাথে আমার খুব ভাল একটা বন্ধুত্বের সম্পর্ক জন্মায়। এবং এভাবেই আসতে আসতে তার প্রতি ভাললাগা অনিচ্ছাকৃত ভাবেই হয়ে যায়। আমি তখন পর্যন্তও জানতাম না যে সে কোনো এক কঠিন রোগে আক্রান্ত। জেনেছি তার লেখা ডায়রি দেখে। আমার ভাললাগার কথা ফারিয়াকে জানাই। ফারিয়ার কাছে থেকে প্রথমত কোনো অনুমতি পাইনি। প্রায় এক মাস পর তার সম্মতি পেয়েছিলাম। সে থেকেই শুরু হয় আমাদের সুন্দর মুহূর্তগুলো। দিন দিন তার প্রতি ভালবাসাটা যেনো বেড়েই যাচ্ছিলো। তবে সেটা কোনো একভাবে ফারিয়ার বাবা জেনে যায়। আমি ভয়ে ভয়ে থাকতাম এর জন্যই যদি স্যারের সামনা-সামনি পরে যাই তখন কি উত্তর দিবো তাকে।
.
রিলেশনের দেড় বছর পর আমাদের মধ্যে কিছুটা ঘাটতি দেখা যায়। ফারিয়া ইগনোর করতে শুরু করে দেয়। তবে তখন অবদি আমি জানতাম না এর কারণ। প্রায় ২ মাস পর ফারিয়া আমাকে কল করে। এবং মোবাইলের স্ক্রিনে তার ছবিটা ভেসে উঠে দেখতে পেয়ে খুবই আনন্দিত হই। সাথে সাথে কলটা উঠাই।
- হ্যালো। কি ব্যাপার এতদিন পর কোথা থেকে আসলে?
- হৃদয় তোমার সাথে আমার কিছু কথা বাকি আছে। সেটা বলার জন্যই তোমাকে কল দেয়া।
- মানে? এভাবে কথা বলতেছো কেনো? কি হয়েছে তোমার?
- না কিছু হয়নি। < হাপাচ্ছিলো সে >
- আচ্ছা বলো কি বলার বাকি আছে তোমার।
- আসলে আমি রিলেশনটা আর রাখতে চাচ্ছিনা। তুমি আমাকে ভুলে যাও দয়া করে।
- মজা করছো ফারিয়া?
- আমি সিরিয়াস।
  কথাটি বলেই কলটি কেটে দেয় ফারিয়া। আমি অনেকবার কলে ট্রাই করি কিন্তু তার মোবাইল বন্ধ। তখন আমার মনে হচ্ছিলো সবকিছু শেষ করে বহুদূরে চলে যাই। এভাবে হতাশা হয়ে কেটে যাচ্ছিলো দিন। ইন্টার ২য় বর্ষের ফাইনাল পরিক্ষা শেষ হয়। কিন্তু ফারিয়া আমাদের সাথে পরিক্ষা দেয়নি। মনে মনে ফারিয়ার প্রতি অনেক বেশি ঘৃণা জন্মায়। তবে ভুলতে পারিনি তাকে। ইন্টারের পরিক্ষাটা তেমন ভাল হয়নি। রেজাল্ট খারাপ হয়। যার কারণে বাসা থেকে অনেক কথা শুনতে হয়। তাই অনার্সে আর ভর্তি হইনি। মালয়েশিয়া চলে আসি কিছুদিনের মধ্যেই। কাজের চাপে হয়তো ফারিয়াকে ঠিকই মনে পড়তো না। কিন্তু ঘুমানোর সময় পুরোনো সব স্মৃতিগুলো চোখের সামনেই ভেসে উঠতো।
  তবে আমি দিনের পর দিন তার কন্টাক্ট নম্বরে চেষ্টা করে যাচ্ছিলাম কিন্তু তার ঐ নম্বর বন্ধ পেতাম। পাঁচ বছর পর বাংলাদেশে ফিরে আসি। সব কিছুই যেনো পরিবর্তন হয়ে গেছে। আমিও কিছুটা ভুলতে পেরেছি তাকে। দেশে এসে ব্যবসার কাজে ব্যস্ত হয়ে যাই। এর মধ্যে ফারিয়ার বাবা মানে আমার স্যার তার সাথে রাস্তায় দেখা হয়ে যায়। স্যারের সাথে কথা বলতে গেলাম কিন্তু স্যার চলে গেলো। তখন খুব বেশি রাগ উঠে যায়। রাগ করে বাসায় চলে আসলাম।
  এইদিকে বাসা থেকে বিয়ের জন্য কথা উঠছিলো। সম্মতি দিচ্ছিলাম না। তবে একটা সময় ঠিকই সম্মতি দিতে হয়। নতুন সংসার অচেনা একটা মেয়ে। একটু সময় লেগে যায় তার সাথে নিজেকে মিলিয়ে নিতে। বিয়ের কয়েকমাস পর আনিকা আমার সামনে একটা ডায়রি নিয়ে আসে। আনিকা আমার স্ত্রীর নাম।
.
- কিসের ডায়রি এটা?
- জানিনা তো। আম্মা বললেন আপনাকে দিতে তাই দিলাম।
- ওহহহ আচ্ছা।
  মা'কে গিয়ে জিজ্ঞাসা করলাম কিসের ডায়রি। মা বললেন ফারিয়ার বাবা দিয়ে গেছেন। মা'য়ের কথাটি শুনে একটু চমকিয়ে যাই। কিসের ডায়রি এটা। রুমের বেলকোনিতে গিয়ে বসি। এবং ডায়রিটা পড়ছিলাম। তবে পৃষ্ঠা উল্টাতে গিয়ে বুঝতে পারলাম নিচে কোনো একটা কাগজ পরেছে। সেটা উঠিয়ে খুললাম মনে হচ্ছিলো কোনো একটা চিঠি। তাই প্রথমেই চিঠিটা পড়ার জন্য তৈরি হই।
.
হৃদয় কেমন আছো? আশা করি ভাল আছো। তবে আমি না ভাল নেই। জানি চিঠিটা পড়ার সময় তোমার খুব রাগ হবে খুব অভিমান করবে। কিন্তু শেষ অংশটুকু পর্যন্ত পড়ে দয়া করে আমাকে মাফ করে দিও। " এই অংশটুকু পরে আর পড়তে ইচ্ছে করছিলো না"। তাই রেখে দিলাম। রুমে গিয়ে শুয়ে পরি। ভাল লাগছিলো না। তখন রাত ১২ টা বাজবে। আনিকা ঘুমাচ্ছিলো কিন্তু আমার তো ঘুম আসছিলো না। চিঠিটার শেষ টুকু পড়তে ইচ্ছে করছিলো। তাই ড্রয়ার থেকে ডায়রিটা বের করে সে চিঠিটা হাতে নেই। এবং পূনরায় পড়তে শুরু করি।

আমি তোমাকে অনেক ভালবাসতাম। আমার জীবনের চেয়েও অনেক বেশি। কিন্তু বিধাতা তা চায়নি। একদিন সকালে ঘুম থেকে উঠে ফ্রেশ হতে যাবো তখন দেখি নাক-মুখ দিয়ে রক্ত বের হচ্ছে। তাড়া-তাড়ি করে বাবার রুমে যাই। বাবা আমার এরকম অবস্থা দেখতে পেয়ে হসপিটালে নিয়ে যায়। তখনও আমি জানতাম না কি হয়েছে বা কেনো নাক-মুখ দিয়ে রক্ত বের হচ্ছে। বাবা কথাটা আমার কাছে লুকায়। আর আমিও তোমার কাছে এই কথাটা লুকিয়েছিলাম।  কিন্তু কয়েকদিন পর যখন আবারও এরকম অবস্থা হয়। তখন আমি জানতে চাই কি হয়েছে আমার। কিন্তু বাবা তখনও বলেননি। তবে লুকিয়ে রাখা রিপোর্টটা আমি নিয়ে দেখি। রিপোর্টে স্পষ্ট ভাবে লেখা ছিলো আমার ব্লাড ক্যান্সার। জানো হৃদয় আমার প্রথমে বিশ্বাসই হচ্ছিলো না যে আমার এমন কিছু হয়েছে। আমার মনে হচ্ছিলো কোনো একটা ভুল দেখছি। কিন্তু পরে ভাল ভাবে দেখে আর মনে হলো না সেটা ভুল ছিলো। আমি আর কয়েকমাস বাঁচবো। কিন্তু তোমাকে ছেড়ে চলে যেতে পারতাম না। তাই নিজের সাথে নিজেই লড়াই করে তোমার সাথে কন্টাক্ট করা বন্ধ করেছিলাম। যাতে তুমি আমাকে ভুল বুঝো। কিন্তু হৃদয় শুনো আমি তোমাকে অনেক ভালবাসতাম। আমার খুব স্বপ্ন ছিলো আমাদের একটা সুন্দর সংসার হবে। সে সংসারের রাণী হতে চেয়েছিলাম। কিন্তু পারলাম না তোমার রাণী হতে। হেরে গেলাম আমি। আমাকে মাফ করে দিও হৃদয়।
                   -ইতি তোমার ফারিয়া।
চিঠিটা পড়ে চোখ দু'টি নিমিষেই ভিজে গেলো। দৌঁড়ে ওয়াশরুমে চলে যাই। পানির কলটা ছেড়ে হাউমাউ করে কিছুক্ষণ কেঁদেছি। আমি এভাবে কখনো কাঁদিনি। তবে নিজেকে সামলাতে পারছিলাম না। ঔযু করে নফল নামাজ পড়লাম। এবং মোনাজাতে ফারিয়ার জন্য দোয়া চাইলাম আল্লাহ্‌র কাছে।
  কিছু গল্প অসমাপ্তই হয়ে থাকে। চাইলেও সমাপ্ত করা যায় না। তবে বেঁচে থাকার জন্য অনেক লড়াই করতে হয়। তবে তার কাছে আমি হেরে গেলাম।
(( হৃদয় নাদিম))

Comments