(১)
.
ঘড়ির কাটা যেমন ঘুরে ঘুরে একটা দিন পাড়ি দিচ্ছে ঠিক তেমনি নিজের জীবন থেকে একটু একটু করে শেষ হতে চলছে সময়। জীবন পাড়ি দেয়া বড় কষ্টদ্বয়। সুখ আর দুঃখ মিলেই পাড়ি দিতে হচ্ছে জীবন। আর একটা জীবনকে সুন্দর ভাবে গড়ে তোলার জন্য প্রয়োজন কিছু সুন্দর সুন্দর মুহূর্ত। যা অন্ধকারে আলোর মতো জ্বলে উঠতে সাহায্য করে।
.
এক অচেনা শহরের অচেনা মানুষের সাথে যেভাবে খুব চেনা হয়ে যায় তেমনি ভাবে চেনা মানুষ গুলাও একটা সময় খুব অচেনা হয়ে যায়। এর একমাত্র কারণ হলো মনোভাব। যা সম্পর্ক বিহীন দ্বারাবতীকেই এগিয়ে যায়। মানুষ মানুষের জন্য কথাটি তখনই শক্ত ভাবে বলা যায় যখন কেউ কারো সাহায্যার্থে হয়ে থাকে।
.
এই গল্পটি এক অচেনা মানুষের কিভাবে যে খুব চেনা হয়ে যায় তা শুধু সময়ের অপেক্ষাকৃত ভাবেই বোঝা যায়।
.
- কেমন আছেন?? <পিছন থেকে কেউ বললো >
- আমাকে বলছেন?
- হ্যাঁ আপনাকেই বলছি।
- আলহামদুলিল্লাহ্ ভাল আছি। কিন্তু আপনাকে তো চিনতে পারলাম না।
- আমি সুজানা।
- সুজানা?
- হ্যাঁ। আপনার নাম?
- আমার আবার নাম।
- এভাবে বলছেন কেনো?
- নাহ এমনি।
- আসলে কিছু মনে না করলে একটা কথা জিজ্ঞাসা করতে পারি??
- জ্বী বলুন।
- আপনাকে প্রায় সময়ই দেখি এখানে। কিন্তু কারণটা জানিনা।যদি বলতেন খুব অনুপ্রেরিত হতাম।
.
চুপ-চাপ মাথা টা নিচু করে দাঁড়িয়ে আছে। হয়তো তার বুকের মধ্যে হাজারো কষ্টের সমাহার লুকিয়ে রয়েছে।
- কি হলো শেয়ার করা যাবে?
- অন্য আর একদিন না হয় বলবো। আজ এইগুলো মনে করতে ইচ্ছে করছে না।
- আচ্ছা ঠিক আছে। কিন্তু আবার কবে দেখা হচ্ছে?
- তা ঠিক জানিনা। তবে দেখা হবে একদিন না একদিন।
- আচ্ছা আমার মনে হচ্ছে কিছু একটা আপনাকে প্রতিনিয়ত আঘাত করছে। যদিও আপনি আমাকে কিছু বলছেন না। তাই ঠিক বুঝতেও পারছি না।
- পরে এক সময় বলবো।
.
বলেই দ্রুত হেটে চলে যেতে লাগলো হৃদয়। কয়েক ফোটা অশ্রু জড়ে যায় তার চোখ থেকে। যেটা সুজানা খেয়াল করে। কিন্তু তাকে আর পিছু ডাকেনি। সুজানা মনে মনে ভাবছে কি এমন ব্যর্থতা তাকে এভাবে একা করে রেখেছে। সুজানাও চলে আসে সে জায়গা থেকে
.
সুজানা ছিলো খুবই ভদ্র মেয়ে। তার মা ছোট বেলাতেই তাকে ছেড়ে বহুদূরগামী পথে চলে যায়। আর যখনই তার মায়ের কথা মনে পরে তখনই সে একা থাকে। কিন্তু এইখানেই হৃদয় কে দেখে। আর মনের অজান্তেই সুজানা হৃদয় কে পছন্দ করে ফেলে।
.
একদিন সুজানা দেখতে পায় কয়েকজন পথ শিশুদের সাথে হৃদয় বসে আছে। কিছুটা আড়ালে গিয়ে দেখতে পেলো। পথ শিশুদের নিয়ে অনেক হাসি-খুশি ভাবে কথা বলছে। এবং সবার হাতে নতুন নতুন কাপড়। সুজানা ঐ খানে দাঁড়িয়ে দেখছে সব কিছু। কিছুক্ষণ পর চলে যায় হৃদয়।
.
সুজানা এবং পথ শিশুর সাথে কথোপকথনঃ
.
- এই ছেলে শুনো।
- জ্বী আপা বলেন।
- যে লোক টি এতক্ষণ এখানে ছিলেন উনি কে?
- হৃদয় ভাইয়ের কথা বলছেন?
- উনার নাম হৃদয়?
- জ্বী আপা।
- আচ্ছা উনার ব্যাপারে আমাকে বলবে??
- কি শুনতে চান বলুন?
- উনার পরিচয় কি?
- হৃদয় ভাই এমন একজন মানুষ। যার তুলনাই হতে পারে না আপা। উনার বাবা-মা কেউ নেই। একজন ছোট ভাই ছিলো। তাকেও আল্লাহ্ তা আলা তার কাছে নিয়ে গেছেন। তার মনে অনেক কষ্ট লুকিয়ে আছে। এই যে আমাদের দেখছেন সবাইকে তার ছোট ভাইয়ের মতো আদর করে। এমন কোনোদিন বাদ নেই যে আমাদের সাথে দেখা করেন না। আমাদের সাথে তার সব কিছু শেয়ার করে। এই যে দেখেন আমাদের জন্য কতো সুন্দর সুন্দর কাপড় নিয়ে আসছে।
- আগামীকাল ও কি তাকে এখানে পাওয়া যাবে?
- জ্বী আপা। কিন্তু কেনো আপা?
- না এমনি ভাই।
- আচ্ছ আপা তাহলে এখন কাজে যাই।
- কি কাজ করো তোমরা?
- যখন যা পাই তাই করতে হয়। এখন বেশি কাজ করতে হয় না।
- কেনো?
- হৃদয় ভাই আমাদের খাবারদাবার এর জন্য মাসে মাসে টাকা দিয়ে রাখে হোটেলে। কিন্তু আমরা লুকিয়ে লুকিয়ে কাজ করে থাকি। হৃদয় ভাই জানতে পারলে বকা দিবে।
- কাজ করো কেনো তাহলে?
- আপা একটা মানুষের পক্ষে আর কতো সম্ভব বলেন? হৃদয় ভাই আমাদের জন্য যথেষ্ট করে আসছে। যাতে তার একটু কষ্ট কম হয় এর কারণেই কাজ করি।
- আচ্ছা আজ থেকে আমি তোমাদের বড় বোন। কি আমাকে বোন বলে ডাকবে তো?
- আপা সত্যি বলতেছেন?
- হ্যাঁ ভাই সত্যি।
- আচ্ছা আপা।
- কাল তোমাদের জন্য আমি বাসা থেকে খাবার রান্না করে নিয়ে আসবো। ঠিক আছে?
- আচ্ছা আপা।
.
পায়ে ধরে সালাম করতে যায় এমন সময়ই সুজানা আটকায়।তাদেরকে বুকে জড়িয়ে নেয়। এরকম মানুষ পাওয়া খুব ভাগ্যের ব্যাপার। সুজানা এসে পরে। এবং তার চোখ থেকে অশ্রু জড়ে যায়। এটা হচ্ছে ভালবাসার অশ্রুজল।
.
(২)
.
যত দেখছে ততই মুগ্ধ হচ্ছে সুজানা। একটা মানুষ এত ভাল হয় কিভাবে? এরকম হাজার টা প্রশ্ন মনে মনে ঘুরপাক খাচ্ছে সুজানার। আর হৃদয় কেও তো সুজানা অনেক বেশি ভালবেসে ফেলে। এখন শুধুই হৃদয়কে জানানো বাকি। কিন্তু হৃদয় কি সেটা মেনে নিবে। এইসব ভাবতে ভাবতেই মনে পরে যায় পথ শিশুদের কথা।
.
আসলেই তো আমাদের মতো তারাও মানুষ। তাদের মনেও তো কতো কতো ইচ্ছে লুকিয়ে আছে। কিন্তু ইচ্ছে গুলো বাতাসে ধুলোবালির মত উড়ে যাচ্ছে। কেনো জানি খুব বেশি আপন ভেবে নিতে ইচ্ছে করে সুজানার। আল্লাহ্ সবাইকে তার নিজের হাতেই সৃষ্টি করেছেন এবং তিনি যার যেখানে অবস্থান সেখানেই রেখেছেন।
.
একটা প্রবাদবাক্য আছে যে,,,
"চেষ্টা করা আমার কাজ
পূর্ন করা উপর আলা'র কাজ"
.
যত টুকু চেষ্টা করা দরকার আমাদের করতে হবে এবং সেটা পূর্ন করবেন তিনিই। যিনি আমাদের সৃষ্টিকারী। ইনশাআল্লাহ আল্লাহ্ রহমতে অনেক ভাল আছি অনেক ভাল রেখেছেন।
.
পরেরদিন ঠিক একই সময় সুজানা ঐ খানে যায়। হৃদয় তখনো আসেনি সেইখানে। পথশিশু গুলো সুজানাকে দেখে তার কাছে আসে। খুব খুশি হয়েছে তাকে দেখে।
.
- আপা আপনি আসছেন? কেমন আছেন আপা?
- আলহামদুলিল্লাহ্ ভাইয়ারা ভাল আছি। তোমরা সবাই কেমন আছো??
- আমরাও ভাল আছি।
- সবাই বসো এখানে। আজ একসাথে খাবো সবাই।
- আচ্ছা আপা।
.
সবাই কতো হাসি-খুশি। এই আনন্দ কোটি টাকা দিয়েও কেনা যাবে না। সবাই বসে একটা মাঠের মতো ছোট জায়গাটাতে। সুজানাও তাদের সাথে বসে খাচ্ছে। এর কিছুক্ষণের মধ্যেই হৃদয়কে দেখতে পায় সুজানা। অনেকক্ষণ ধরেই দাঁড়িয়ে আছে সব কিছুই দেখতে পেলো।
.
- ভাই
বলেই কয়েকজন শিশু দৌঁড়ে গিয়ে হৃদয় কে জড়িয়ে ধরে। এটাই হচ্ছে ভালবাসা।
.
- কি ব্যাপার আপনি?
- হ্যাঁ আমিই। কেনো আমার কি এখানে আসা মানা?
- ঠিক তা নয়।
- তাহলে??কি?
- কখনো ভাবিনি আপনাকে এভাবে দেখতে পাবো। আর ।
- আর কি??
- না কিছু না। তো কেমন লাগছে ওদের কাছে থেকে ?
- অনেক বেশি ভাল।
.
বলে রাখা ভাল সুজানা খুব ধনী পরিবারের মেয়ে ছিলো। তার পোষাক আষাক দেখলে কেউ বিশ্বাসী করতে পারবে না। ঠিক তেমনই হৃদয় ও শক খায় সেইখানে সুজানা কে দেখে।
.
- তো মিস্টার হৃদয়। আপনি কেমন আছেন?
- আলহামদুলিল্লাহ্ অনেক ভাল আছি। কিন্তু আপনি আমার নাম কিভাবে জানলেন?
- শুধু নাম নয় আরো অনেক কিছুই জেনেছি বুঝেছি।
- ওহহহহহ আচ্ছা।
- হুমমম।
.
সেইদিনের মতো করে ঐ খান থেকে বিদায় নিয়ে চলে আসে তারা। ঐদিন থেকেই তাদের মধ্যে ভাল বন্ধুত্ব সৃষ্টি হয়। এভাবেই চলতে থাকে।
.
৩ মাস পরঃ
হৃদয় এবং সুজানার ফোনে কথোপকথনঃ
- হ্যালো হৃদয়
- হ্যাঁ সুজানা বলো।
- আচ্ছা একটা কাজ করলে কেমন হয়?
- কি কাজ?
- ওদেরকে যদি আমাদের বাড়িতে এনে রাখি। তাহলে কেমন হয়?
- বেশ ভাল কথা কিন্তু তোমার পরিবার কি মানবে?
- ঐ টা আমার ব্যাপার। আমার উপর ছেড়ে দাও। মানিয়ে নেওয়ার দায়িত্ব আমার।
- আচ্ছা তাহলে ঠিক আছে।
.
সুজানার মতো তার বাবার মনটাও অনেক সুন্দর ছিলো। তার বাবা খুব সহজে মেনে নেয়। আর সুজানার সব কথাই তার বাবা মানে।
.
একটা সময় সুজানাদের বাড়িতে পথ শিশুদের জন্য একটা থাকার স্থান হয়ে যায়। এভাবে অল্প অল্প করে প্রায় ৭০ জন পথ শিশুর থাকার জায়গা হয়ে যায়। সবই ভালভাবেই কেটে যাচ্ছিলো।
.
আর তাদের বন্ধুত্ব টা ততদিনে অনেক গভীর হয়ে ভালবাসার সম্পর্কে পরিণত হয়ে যায়।
.
.
.
লেখাঃ হৃদয় নাদিম
.
(সমাপ্ত)
Comments
Post a Comment