ডায়রির শেষ পাতা


চাঁদটাকে ভালো লাগতো তখনই যখন তোকে ঐ চাঁদের সাথে বর্ণনা করতাম। আকাশের দিকে তাকিয়ে থাকতাম প্রতিরাতে চাঁদ দেখার জন্য নয় তোকে দেখার জন্যই। কারণ তুই বলেছিলি যখন আমি থাকবো না তখন ঐ চাঁদটির মাঝে আমাকে স্মরণ করলে পাবে। এখন তুই বহুদূরে যেমনটা চাঁদ আমার থেকে অনেকটা দূরে। চাইলেও চাঁদটাকে ছুতে পারবো না। আর ঠিক তোকেও ছুঁয়ে দেখতে পারবো না। তুই বলেছিলি কখনো আমাকে ছেড়ে দূরে কোথাও চলে যাবি না। কিন্তু তুই ঠিকই স্বার্থপরের আমাকে একা রেখে চলে গেলি। কেনো এমনটা করলি? কি দোষ ছিলো আমার যে কারণে তুই তোর কথাটি রাখতে পারলি না।
.
গল্পটা এক মা হারা ছেলের। যার মা নেই সেই একমাত্র বুঝতে পারে মা হারানোর বেধনা। কতটা যন্ত্রনা ও কতটা কষ্টের। মায়ের ভালবাসার মধ্যে অন্য কোনো ভালবাসার বর্ণনা কোনোভাবেই করা যায় না আর যাবেও না। কারণ মা তোকে খুব বেশি ভালবাসি রে। তোকে ছাড়া এখন আমায় কেউ আর আদর করেনা। কেউ বুঝে না আমার মনের কথা। তুই যেভাবে আমার কিছু না বলাতেই সব কিছু বুঝে যেতি। আমার চোখের দিকে তাকিয়েই বুঝে যেতি আমার মন খারাপ থাকলে। এখন আর কেউ তোর মতো আমায় বুঝে না। মা তুই ছাড়া আমি অসহায়।
.
২০ বছর আগের কথা। হৃদয় নামের একটি ছেলের শেষ ডায়রির পাতার লেখাটা ঠিক এইরকমই কিছু লেখা ছিলো।
.
হৃদয় তার জন্মের ৫ বছর পরই তার বাবাকে হারায়। বাবার ভালবাসা, আদর তেমনটা পায়নি। হৃদয় তার বাবা-মায়ের এক মাত্র সন্তান। তার বাবা সরকারি একটা চাকরি করতো। তখন খুব ভাল ভাবেই তাদের সংসার চলে যেতো। হঠাৎ একদিন রাস্তা পাড় হওয়ার সময় রোড এক্সিডেন্টে তার বাবাকে হারায়। হৃদয় ছোট ছিলো তখন। তাই তখন তার মা তাকে শান্তনা দিয়েই রাখতো। কখনো বাবা হারাবার কথা মনেও করায়নি।
.
এভাবে কেটে যায় ২ টি বছর। পরে হৃদয়কে স্কুলে ভর্তি করে। হৃদয় তার মায়ের কাছ থেকে দু'জনেরই ভালবাসা পায়। তার মা কখনো হৃদয় এর বাবার ভালবাসা কমতি রাখেনি। হৃদয় এর মা ই ছিলেন তার বাবা এবং তার মা। একদিন হৃদয় তার মা'কে জিজ্ঞাসা করে, আচ্ছা মা বাবা কোথায়? তখন তার মা আঁচল দিয়ে চোখটি মুছে বলে আয় আমার সাথে। চাঁদের নিচে দাঁড়িয়ে বলে ঐ যে দেখছিস চাঁদটি? ঐ খানেই তোর বাবা আমাদেরকে দেখছে। আমাদের সব কথা শুনছে।
.
কিছুদিন পর হৃদয় বুঝে যে তার বাবা নেই। কিন্তু হৃদয় তার বাবাকে অনেক মনে করতো। যখন হৃদয়ের বন্ধুরা তাদের বাবার সাথে যেতো তখনই তার চোখের পানি ঝড়তো। আর রাতের বেলায় আকাশে চাঁদের দিকে তাকিয়ে কথা বলতো। এভাবে আসতে আসতে হৃদয় স্কুল জীবন শেষ করে কলেজে ভর্তি হয়। তখন টিউশুনি করে তার মাকে সাহায্য করতো। বাবা'কে প্রতিনিয়ত খুবই মিস করতো হৃদয়।
.
এভাবে কাটছিলো তার জীবন। একদিন টিউশুনি থেকে বাসায় এসে দেখে তার মা ঘুমিয়ে আছে। হৃদয় তখনও বুঝেনি যে তার মা আর বেচে নেই। হৃদয় ভেবেছে হয়তো ঘুমিয়ে আছে। কিছুক্ষণ পর তার মায়ের রুমে গিয়ে তার মাকে ডাকে। কিন্তু তার মা কোনো কথা বলছে না। যখন কাছে গেলো তখন আর বুঝতে বাকি রইলো না তার। জোড়ে চিৎকার করে কেঁদে উঠে হৃদয়। আশের পাশের মানুষেরা ছুটে আসে হৃদয়ের কান্না শুনে। হৃদয় তখন একেবারেই ভেংগে পড়ে। হৃদয় এর শেষ সম্ভলই ছিলো তার মা। কিন্তু তখন তার মা ও অনেক দূরে চলে গেছেন।
.
মা'কে ভেবে প্রতি রাতই চোখের পানি ফেলতো। বাসার সাথেই তার মাকে কবর দেয়। খুব বেশি মনে পড়লে মায়ের কবরের পাশে বসেই মাটিতে বুক লাগিয়ে কাঁদতো। বাবা - মা হারা ছেলেটার অবস্থা তখন কেমন হতে পারে সেটা আপনারা বুঝতে পারছেন হয়তো। প্রিয়জনদের হারিয়ে ফেলে হৃদয়। তখন হৃদয়ের ১৮ বছর হয়। একা একাই তার জীবনকে পাড়ি দিচ্ছিলো। কিন্তু বিধাতা তাকেও একদিন তার বাবা- মা'য়ের কাছে পাঠিয়ে দেন। "জন্মালে মরিতে হবে" 'আল্লাহ্‌ তা আলা বলেছেন, সবাইকেই মৃত্যুর স্বাধ গ্রহণ করতে হবে। আমি মানব সৃষ্টি করেছি মাটি দিয়ে এবং সবাইকেই একদিন না একদিন মাটি হয়ে হয়ে যেতে হবে।
.
এর কিছুদিনের মাঝে হৃদয় একটা চাকরি পেয়ে যায়। তার আয় যতটুকু ছিলো তা রেখে বাকি সবটুকু মসজিদে, মাদ্রাসা ও এতিমখানায় দিয়ে দিতো। হৃদয় পাঁচ ওয়াক্ত সালাত আদায় করতো। এবং তার প্রতিটা মোনাজাতে তার মা বাবা' কে স্মরণ করতো। একটা সন্তানের দোয়ায় তার মা-বাবা জান্নাতবাসী হতে পারে। তার কয়েক বছর পর হৃদয় অসুস্থ হয়ে যায়। হাসপাতালে ভর্তি হয়। চিকিৎসকের কাছ থেকে জানতে পারে তার হার্ট ডেমেজ হয়ে গেছে।
.
হৃদয় ও ভাবছে সে তার মা-বাবার কাছে চলে যাবে। এবং ডায়রিটার শেষ পাতায় শেষ লেখা লিখে। হৃদয় ও তার মা-বাবার কাছে চলে যায়।
ডায়রিতে শেষ লেখাটি ছিলো।
.
" মা- বাবা আমি তোমাদের কাছে আসছি"
.
.
.
লেখাঃ হৃদয় নাদিম

Comments