অফিস থেকে আজ ৭ টায় চলে আসছি। কারণ আম্মা একটু অসুস্থ কয়েকদিন ধরেই। আম্মার অসুস্থতার জন্য কয়েকদিন ধরে আরিফা রান্না করছে। কিন্তু আরিফার রান্না যে এত জগন্য সেটা না খেলে বুঝতেই পারতাম না। গত চারদিন ধরে রাতের খাবার হোটেল থেকে খেয়ে বাসায় ফিরতাম। কিন্তু হোটেলের খাবারের স্বাদ আম্মার খাবারের স্বাদের মতো হচ্ছে না। তাই চিন্তা করলাম আজ তাড়া-তাড়ি বাসায় ফিরে নিজেই রান্না করবো। বাসার দরজার সামনে এসে কলিংবেল চাপলাম। প্রায়ই দুই মিনিট দাঁড়িয়ে থাকার পর আব্বা এসে দরজা খুলে।
" আজ এত তাড়া-তাড়ি বাসায় ফিরলি? "
কিছু না বলে বাসার ভেতরে ঢুকলাম। আব্বা দরজা খুলেছে তাই কিছু বলতে পারিনি। আরিফা দরজা খুললে সব রাগ তার উপর দেখাতাম। আমার রুমে গিয়ে ফ্রেশ হয়ে আম্মার রুমে যাই। আম্মাকে গিয়ে জিজ্ঞাসা করলাম।
'আম্মা তোমার শরীরটা কেমন এখন? আম্মা কথার উত্তর দিলো 'আগের থেকে ভাল আছি বাবা। আজ এত তাড়া-তাড়ি বাসায় আসলি যে? 'না আম্মা এমনি। তোমার আদরের মেয়েটা কোথায়? নিশ্চয়ই ফোন নিয়ে ব্যস্ত? 'বাবা আরিফাকে আর বকা-জোকা করিস না। মেয়েটা সারাদিন বাসার কাজ করে এখন একটু আরাম করছে।
কিছু না বলে আম্মার রুম থেকে বের হয়ে যাই। সোজা গিয়ে রান্নাঘরে ঢুকলাম। ফ্রিজ থেকে মুরগি বের করি। গতকাল ইউটিউবে দেখেছিলাম কিভাবে মুরগির মাংস রান্না করতে হয়। তা দেখেই আজ রান্নাঘরে আমি। মনে বিশ্বাস ছিলো যে অন্তত আরিফার থেকে ভাল রান্না করতে পারবো। রুমে গিয়ে মোবাইলটা নিয়ে আসলাম ইউটিউব চালু করে গত রাতের ভিডিওটা আবারো দেখতেছিলাম। দেখার মাঝেই আরিফা এসে হাজির।
'ভাইয়া? তুমি রান্নাঘরে কি করছো? আজ বাহিরে থেকে খেয়ে আসনি? ' আমি ওর কথায় কোনো কান দিলাম না। ভিডিওটা দেখতে ছিলাম। আমার কথার উত্তর না পেয়ে আরিফা আমার সামনে এসে মোবাইলের দিকে তাকিয়ে দেখতে পায় আমি ইউটিউবে রান্নার রেসিপি দেখছি। সেটা দেখে আরিফা আবারও বলে। 'আজ কি তুমি রান্না করবে নাকি? তখন রিপ্লাই দিলাম 'হ্যাঁ আমি করবো। 'আমাকে বললেই তো হতো আমি রেঁধে দিতাম।' 'তুই রান্না করবি? আর ঐ টা আমি খাবো? তোর রান্না একদিন খেয়েই আমার স্বাদ মিটে গেছে। সারাদিন তো মোবাইল নিয়ে পরে থাকিস। ইউটিউব থেকে তো রান্নার রেসিপি শিখতে পারিস। কিন্তু না তা কেনো শিখবি। ' ভাইয়া তুমি আমার সাথে এভাবে কথা বলছো কেনো? আমি কি রান্না করতে পারি না? 'কি যে রান্না পারিস তা আমার জানা হয়ে গেছে। এখন এখান থেকে গেলে খুশি হবো। ' হুহ। দেখবো নে কি রান্না করো। '
মুখ ভেংচি দিয়ে চলে গেলো আরিফা। আম্মা অসুস্থ হওয়ার পর আরিফা রান্না করেছিলো। অফিস থেকে বাসায় এসে খেতে বসেছিলাম। সেইদিন খাওয়া শেষ করে বিছানায় গিয়ে একটু শুয়ে ছিলাম। ১০ মিনিট পরই পেট কামড়াচ্ছিলো। বিছানা থেকে উঠে দৌঁড়ে ওয়াশরুমে গেলাম। ঐ দিন টানা পাঁচ থেকে ছয়বার আসা যাওয়া করেছি। কাউকে জানানো হয়নি সে ব্যাপারটা। পরে স্যালাইন খেয়ে সে বিপদ থেকে কিছুটা রক্ষা পেয়েছিলাম। পরের দিন সকালে অফিসে যাওয়ার আগে আম্মার কাছ থেকে জানতে পারি যে আরিফা গতকাল রাতে রান্না করেছিলো। আর তার রান্না খেয়েই আমার পেট খারাপ মানে ডায়রিয়া হয়েছিলো। তাই সেইদিন আর খাবার নিয়ে গেলাম না।
মুরগির মাংস রান্না করতে প্রায় আধা ঘন্টার মত লেগে যায়। রান্না শেষ করে প্লেটে ভাত নিয়ে আগে আমিই খেলাম। না ভাল হয়েছে। মনে মনে নিজের প্রশংসা নিজেই করি। সে রাতে সবাই আমার রান্না করা মুরগির মাংস দিয়েই রাতের খাবার শেষ করে। পরের দিন শুক্রবার ছিলো অফিস বন্ধ। তাই একটু রাত জেগেই ঘুমাই। সকালে ঘুম থেকে উঠি আরিফার ডাকে।
- ভাইয়া, ঐ ভাইয়া, ভাইয়া।
- কী হয়েছে সকাল সকাল চিল্লাচ্ছিস কেনো?
- তাড়া-তাড়ি উঠো।
- কেনো কী হয়েছে?
- বাসায় স্যালাইন ছিলো কিন্তু সেইগুলো তো খুঁজে পাচ্ছিনা।
- স্যালাইন দিয়ে কী করবি?
- স্যালাইন দিয়ে করে মানুষ। কী রান্না করেছো গতরাতে তুমি? তোমার রান্না খেয়ে আমাদের অবস্থা খারাপ হয়ে গেছে। তাড়া-তাড়ি উঠে দোকান থেকে স্যালাইন নিয়ে আসো।
- কী বলিস।
বিছানা থেকে উঠে সোজা বাজারে চলে গেলাম। সকাল ৭ টা বাজে তখন। এরকম শীতের মধ্যে কোনো দোকান খুলেনি। অনেক ঘুরা-ঘুরি করার পর স্যালাইন নিয়ে বাসায় ফিরি। বাসায় ফিরবার সময় মনে মনে ভাবছিলাম 'আমার তো কিছুই হল না। তাদের পেট এ সমস্যা দিলো কেনো? খুব তো ছোট বোনের সাথে ভাব নিয়ে রান্না করেছিলাম। আল্লাহ্ জানে বাসায় গিয়ে কত বকা শুনতে হয়। বাসায় গিয়ে স্যালাইন এর বক্সটা আরিফার হাতে দিলাম। না আর ঘুম আসছিলো না। রান্না তো ঠিকই মত করেছিলাম। একেবারে ভিডিওতে যেভাবে দেখিয়েছে। কিন্তু এরকম কেনো হলো? অনেক কিছু ভাবা-ভাবি'র পর ঘুমিয়ে পরলাম। ১০ টায় ঘুম থেকে উঠে ফ্রেশ হই। তখন ফ্রেশ না হয়েই স্যালাইন আনতে গিয়েছিলাম। ফ্রেশ হওয়ার সময় পাইনি। কারণ আমি বুঝেছিলাম স্যালাইন না খাওয়ার অপকারিতা। আব্বা-আম্মার রুমে গিয়ে উকি মারলাম। পিছনে ফিরে দেখি আরিফা আমার পিছনে দাঁড়িয়ে আছে। বিড়ালের মত মাথাটা নিচু করে রুমে চলে আসলাম। কারণ যেটা হয়েছে সেটার জন্য বিড়ালই হওয়া দরকার ছিলো। কিছুক্ষণ পর আম্মা আমার রুমে আসেন।
- আম্মা তুমি উঠে এসেছো কেনো? আমাকে বললেই তো আমি তোমার রুমে যেতাম।
- শোন বাবা একটা কথা বলি। মেয়েদের কাজ ছেলেদের দিয়ে হয়না।
- ইয়ে মানে। আম্মা আমি বাধ্য হয়েই গতকাল রান্না করেছিলাম। তোমার ছোট মেয়ের রান্না খেয়েও কিন্তু আমার এই অবস্থা হয়েছিলো। কিন্তু আমি তো ঠিক মতই রাঁধলাম।
- সেটাই তো বললাম মেয়েদের কাজ ছেলেরা করতে পারেনা। আর আমার তো বয়স ও কম হয়নি। তোকে তো বিয়ের কথা বলতে বলতে মুখ আমার ব্যথা হয়ে গেছে। আমি আর কতদিন বাঁচবো বল। কথা তো শুনবিই না তোকে বলে আর কী'ই বা হবে।
কথাটি বলে আম্মা চলে গেলো। ঠিকই তো গত দুই বছর ধরে আব্বা-আম্মা বিয়ের জন্য বলতেছে কিন্তু আমি রাজি হইনি। আসলে আমার এই বিয়ে টিয়ের প্যারা ছিলো না। কিন্তু এখন ভাবছি যে একজন রাঁধুনি মেয়ে দেখেই বিয়ে করা দরকার। যে অন্তত ভাল ভাবে রান্না করে খাওয়াতে পারবে। সে'দিন বিকেলে আম্মাকে গিয়ে বলি মেয়ে দেখার জন্য। আম্মা শুনে খুব খুশি হয়েছিলো। ' কিন্তু আম্মা একটা শর্ত আছে। সেটা হলো মেয়ে যেনো ভাল ভাবে রান্না করতে পারে। এমন কাউকে আমার গাড়ের মধ্যে চাপিয়ে দিওনা যেনো আবার তার রান্না খেয়েও এই অবস্থা হয়। ' আম্মা একটাই কথা বললো - প্রয়োজন হলে আমি নিজ হাতে রান্না শিখিয়ে দিবো।' আম্মা কথাটি বলে মোবাইলটা নিয়ে অন্যরুমে চলে গেলেন। আমি ভাবছিলাম নিজের মেয়েটাকেও তো পারো নিজ হাতে রান্না শিখাইতে তাহলে তো আর এরকম একটা প্যারার মুখোমুখি হতে হবে না।
আম্মা আব্বাকে গিয়ে বলে আমি হ্যাঁ বলেছি বিয়ের জন্য। পরে জানতে পারি মেয়ে নাকি আগে থেকেই পছন্দ করে রেখেছে তারা। শুধু মাত্র আমার "হ্যাঁ" এর জন্য অপেক্ষা করছিলো এতদিন। সব কিছু যখন শুনি তখন জানতে পারি মেয়ে আরিফার ফ্রেন্ডের বড় বোন। আরিফা এসে ওর ফ্রেন্ড এর বোনের কন্টাক্ট নম্বর দিয়ে যায় আমাকে। আর হ্যাঁ তার নাম ছিলো সুজানা। আমিও কল করি সেই নম্বরে।
- হ্যালো আসসালামু ওয়ালাইকুম।
- ওয়ালাইকুম আসসালাম।
- সুজানা বলছেন?
- জ্বি। আপনি কে?
- আমি রিয়াদ। আরিফার ভাই।
- ও আচ্ছা। জ্বি কেমন আছেন?
- আলহামদুলিল্লাহ্।
'এভাবে কিছুক্ষণ কথা বলার পর হুট করেই এই কথাটি বলে ফেলি। '
- আচ্ছা আপনি কী কী রান্না করতে পারেন?
- হঠাৎ এই প্রশ্ন কেনো?
- না এমনি জানতে চাইলাম। কেনো কোনো সমস্যা বলতে?
- ঠিক তা না।
- তাহলে? আচ্ছা বাদ দিন।
.
কল রেখে দিলাম। এবং ইউটিউবে গিয়ে ঐ রেসিপির ভিডিওটাতে একটা ডিসলাইক দিয়ে একটা কমেন্ট করলাম 'আপনাদের এইরকম একটা রেসিপি দেখে জীবনে অনেক বড় ভুল করেছি আর এখন সেই ভুলের মাসুল দিতে হচ্ছে আমাকে।'
.
(হৃদয় নাদিম)
Comments
Post a Comment