(১)
মেঘ গুলো ভেসে বেড়াচ্ছে আকাশে। মেঘলা আকাশটা বিষন ভাল দেখায়। তার সাথে হালকা মৃদু বাতাস মন ভাল করার জন্য এরকম একটা বিকেলই যথেষ্ট। কেউ ভালবাসে বিকেলের আবহাওয়া, কেউ ভালবাসে রাতের বেলার আকাশের ঐ চাঁদটিকে। রাতকে সুন্দর করার জন্য আকাশের ঐ চাঁদটিই যেমন দরকার, ঠিক তেমনি মন ভাল রাখতে হাসি-খুশিটাই খুব বেশি প্রয়োজনীয়। হৃদয় এবং রিয়া, তারা দু'জন ভাই-বোন। প্রতিদিন একে অপরের মাথার চুল না ছিড়ে থাকতে পারেনা। ভাই-বোনের ঝগড়া, মা-বাবা কাকে বেশি ভালবাসে তা নিয়ে হিংসে, সব শেষে ভালবাসা। ভাই-বোনের ভালবাসা কখনো ফুরায়না।
'ভাইয়া চলনা ছাদে যাই। আজ আকাশের চাঁদটা না খুব বেশি সুন্দর।' আসলেই চাঁদটি অনেক সুন্দর। চাঁদের নিজস্ব কোনো আলো নেই। তবুও আকাশটি চাঁদের আলোতে ফুটে রয়েছে। সেই রাতটি ছিলো পূর্ণিমা রাত। 'না ভাল লাগছে না। মাথাটা খুব ব্যথা করছে। তুই একা যা রিয়া।' রিয়া ছাদে একা যাওয়ার মতো মেয়ে নয়। অনেক ভীতু, সামান্য এক রুম থেকে অন্যরুমে যেতেও ভয় পায়। আর সে কিনা যাবে ছাদে রাতের বেলায় তাও আবার একা। 'ভাইয়া আমিতো একা ভয় পাই, তুই জানিস না? আচ্ছা যা ছাদে নিয়ে গেলে আমি তোর মাথা টিপে দেবো। ' কথাটি মন্দ লাগলো না হৃদয়ের। তার মধ্যে আবার মাথাটাও ব্যথা ছিলো। 'আচ্ছা চল তাহলে। কিন্তু একটা শর্তে, বেশিক্ষণ থাকা যাবেনা। বিশ মিনিট থাকবো পরে চলে আসবো।'
রাত তখন ১০ টার মতো বাজে। একসাথে বসে কার্টুন দেখছে। তখনই রিয়ার এরকম অদ্ভুত বায়ণা। ' আচ্ছা ভাইয়া তাহলে চল যাই। '
'হুম চল তাহলে যাওয়া যাক' সিঁড়ি বেয়ে বেয়ে উঠতে উঠতে রিয়ার পা ব্যথা হয়ে যায়। উঠতেও পারছেনা আর। পাঁচ তলা পর্যন্ত সিড়ি বেয়ে উঠতে হবে। কিন্তু ও তো তিন তলা পর্যন্ত উঠেই বসে পড়লো সিঁড়ির মধ্যে। 'ভাইয়া আর পারছিনা রে, কাঁধে করে নিয়ে যা না।'
মনে মনে এটাই ভাবছিলো হৃদয় যে, কাঁধে করে নেওয়ার কথা বলবে। আর সেটাই হয়ে গেলো। 'আচ্ছা তাহলে উঠ কাঁধে। কিন্তু বেশি নড়াচড়া করলে কাঁধ থেকে ফেলে দেবো। ' এরকম ভয়টা সবসময়ই দেখানো হতো তাকে। রিয়াও খুব ভয় পায় তা শুনে। একেবারে রোবটের মতো ঝুলে আছে কাঁধের উপর। এত ভীতু মেয়ে কখনো দেখেনি। যেমন ভীতু, তেমন হিংসে ভরা ছিলো।
অবশেষে কাঁধে করেই ছাদে নিতে হয় রিয়াকে। ছাদে উঠে দুই ভাই-বোন এক পাশে গিয়ে দাঁড়ায়। রিয়া চাঁদ দেখছে আর হৃদয় দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে মোবাইল টিপতেছিলো। হৃদয় তো দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে ২০ মিনিটের অপেক্ষা করছে। কখন ২০ মিনিট হবে আর কখন নিচে আসবে। 'ভাইয়া তুই চাঁদ দেখছিস না কেনো? কি সুন্দর দেখতে চাঁদটি।' চাঁদ এমনিতেই অনেক সুন্দরই তার মাঝে আবার চাঁদনি রাত। আরো বেশিই সুন্দর লাগছে। 'তোর চাঁদ দেখা হয়েছে? ২০ মিনিট হয়ে গেছে এখন তাড়া-তাড়ি নিচে চল। আর নাহলে তুই একা একা চাঁদ দেখ, আমি নিচে চলে গেলাম।' কথাটি একটু বিরক্তিকর ভাবেই বলে হৃদয়। তবে এটাই জানতো যে, রিয়া এখানে একা একা কখনই থাকবে না। হৃদয় হাটা শুরু করলো আর তার পিছু পিছু রিয়াও হাটা শুরু করলো। রুমে এসে শুয়ে শুয়ে মোবাইল টিপছে। কিছুক্ষণ পরেই রিয়া তার রুমে প্রবেশ করে। 'ভাইয়া তোর কি মন খারাপ? মাথা ব্যথা কমছে নাকি মাথা টিপে দেবো?' হৃদয় চুপ করে ছিলো। একটু পর রিয়া আবারও জিজ্ঞাসা করলো। 'ভাইয়া কি হয়েছে বল না! 'কিছু হয়নি তুই তোর রুমে যা। আমায় একা থাকতে দে প্লীজ।' রিয়া আর কথা না বলে চলে আসে।
হৃদয় একটি মেয়েকে অনেক ভালবাসতো। অনেক দিনের সম্পর্ক ছিলো তাদের। কিন্তু সে সম্পর্কটা একটা পর্যায় শেষ হয়ে যায়। কিন্তু কি কারণে শেষ করলো সেটা হৃদয় তখন পর্যন্তও বুঝতে পারছিলো না। এই বিষয়টা নিয়েই হৃদয় খুব ভেঙে পড়ে। একা থাকতে চায় সবসময়। একা থাকাটা কেনো জানি তার সংঙী হয়ে যায়।
' হৃদয় ' পাশে থেকে তার মা ডাকে। 'কি হয়েছে তোর বাবা? অনেক দিন ধরেই দেখছি অফিস থেকে এসে সরাসরি রুমে এসে পরিস। তেমন কথাও বলিস না আগের মতো। কি হয়েছে বল না আমায়।' তার মা'য়ের কথাতে কি উত্তর দিবে তাই ভাবছে। 'না মা তেমন কিছু হয়নি এমনি ভালো লাগে না তাই। আদ্রিতার সাথে কিছু হয়েছে? আদ্রিতা হচ্ছে হৃদয়ের গার্লফ্রেন্ডের নাম। তার মা সব কিছুই জানে তাদের ব্যাপারে। হৃদয় আদ্রিতার ব্যাপারে সবকিছুই শেয়ার করতো। তাই হয়তো জানে।
'কি হলো বলছিসনা? আচ্ছা তোর কিছু বলতে হবে না। আমিই আদ্রিতাকে ফোন দিয়ে জানবো কি হয়েছে।' কথাটি বলে তার রুম থেকে বের হয়ে যায় তার মা। অন্যদিকে হৃদয়ের চোখ দিয়ে অশ্রু ঝড়ছে লাগলো। ভালোবাসার মানুষটির সাথে কথা না বলে থাকতে খুব কম মানুষই পারে। যারা পারে হয়তো তাদের মনটাও পাথর হয়ে গেছে।
(২)
পরেরদিন সকালে অফিসে যায় হৃদয়। মন খারাপ থাকলে কোনো কিছুতেই মন বসতে চায় না। তবুও বাধ্য করেই মন বসাতে হয়। অফিস থেকে বাসায় আসার পথে রোড এক্সিডেন্ট হয় হৃদয়ের। হাসপাতালে নিয়ে যায় তাকে কিছু লোক। বাসায় খবর দেয়া হয়। আল্লাহ্র রহমতে তেমন সমস্যা হয়নি। তবে এর চেয়েও অনেক বেশি দূর্ঘটনা হতে পারতো। একটা পা ব্যথাহত হয়। আর হাত কিছুটা কেটে গেছে। ডাক্তার ট্রিটমেন্ট করে সাথে সাথে। এক রাত হাসপাতালে রেখে পরেরদিন সকালেই বাসায় চলে আসে এবং মেডিসিন দিয়ে দেয় এতগুলো। কয়েকদিন বিশ্রাম নেয়ার জন্য বললেন। বাসায় বসে বসে গল্পের বই পড়ছিলো কিছুক্ষণের মধ্যেই একটা অচেনা নম্বর থেকে কল আসে। হৃদয় একটু দ্বিমত করে। তবে ৫ নম্বর কলের সময় রিসিভ করে।
' হ্যালো কে?
- আমি। কেমন আছো তুমি? 'কন্ঠটা চিনতে আর বেশি সময় লাগলো না।'
- হ্যাঁ আলহামদুলিল্লাহ্ ভালো আছি।
- জিজ্ঞাসা করবে না আমি কেমন আছি?
- জিজ্ঞাসা করে কি হবে জানি তুমিও অনেক ভালো আছো।
- আন্টি বললো আজ তোমাদের বাড়িতে আসতে। কিন্তু কেনো যেতে বললো বুঝতেছি না।
- আসতে হবে না। এসে কি করবে?
- হুমম সেটাও ঠিক। আচ্ছা আল্লাহ্ হাফেজ। ভালো থেকো।
'বলেই ফোন রেখে দিলো। আদ্রিতা তখনও জানেনি যে, হৃদয়ের এক্সিডেন্ট হয়েছিল। জানলে হয়তো সরাসরি বাসায় এসেই কথা বলতো। আদ্রিতাও অনেক ভালবাসতো হৃদয়কে। কিন্তু তাদের মাঝে কি এমন বাধা হয়ে দাঁড়ালো যে সম্পর্ক এমন পর্যায় এসে পরলো। সেটা জানতে হলে আর একটু অপেক্ষা করতে হবে।
বিকেলের মধ্যেই আদ্রিতা এসে পড়ে। হৃদয় ঘুমাচ্ছিলো তখন। আদ্রিতা হৃদয়ের রুমে গিয়ে তার সামনে দাঁড়িয়ে কেঁদে দেয়। কারণ হাত পায়ে ব্যান্ডেজ দেখে আদ্রিতা তার চোখের জল ধরে রাখতে পারেনি। তবে তখনও সে কিছু জানতে পারেনি। আদ্রিতা দাঁড়িয়েই আছে এক পলকে তার দিকে তাকিয়ে। তবে কিভাবে জানি হৃদয়ের ঘুম ভেঙে যায়। হতে পারে সেটা মনের টানে। আবার হতে পারে ভালোবাসার টানে। চোখ মেলে তাকাতেই আদ্রিতাকে দেখতে পায়। তবে সেটা স্বপ্ন মনে করে হাতে চিমটি কাটবে এমন সময়ই।
- চিমটি কাটতে হবে না। যা দেখছিস সত্যিই। <পিছন থেকে হৃদয়ের মা এসে বলেন কথা>
এইদিকে আদ্রিতা তাড়া-তাড়ি করে চোখের জল মুছতে গিয়েও হৃদয়ের মা'য়ের চোখে ধরা খেয়ে যায়। 'তোমরা কথা বলো আমি আসছি।
হৃদয় উঠে বসতে চাচ্ছিলো। এমন সময় আদ্রিতা তার পাশে গিয়ে বসে এবং বলে-
- উঠতে হবে না। শুয়েই থাকো।
- কেমন আছো?
- তুমি তো জানোই অনেক ভালো আছি। একটা বার বলারও প্রয়জন মনে করলে না?
- কি বলবো? আর কেনই বা বলবো?
- বলবে না কেনো?
- চলে গিয়েছিলে কেনো?
- সেটাও তো জানতে চাওনি। তাহলে কেনো বলবো?
- এখন তো চাচ্ছি এখন বলো।
' বাসা থেকে তোমার আমার সম্পর্কের কথা জেনে যায় কিভাবে জানি। সেইদিন থেকেই আমার ফোন নিয়ে যায়। বাসা থেকে বের হতেও দেয়নি। তোমাকে যে জানাবো সেটাও পারিনি। আর এই এক মাস আমার উপর দিয়ে যে কি ঝড় গিয়েছে সেটা শুধু আমিই জানি। তা ছাড়া তোমার কন্টাক্ট নম্বর ও তো আমার মুখস্ত নয়। তুমি তো জানোই আমার নিজের কন্টাক্ট নম্বরই মনে রাখতে পারিনা। গতকাল বিকেলে আন্টি যখন ফোন দিয়ে আমাকে চাচ্ছিলো তখন আমার ফোন আম্মুর কাছেই ছিলো। পরে আম্মু আমাকে ফোন দেয়। এর পরেই তোমাকে কল দিয়েছিলাম। এখন বলো আমার দোষটা কোথায়?'
- তাই বলে..
- তাই বলে কি?
- না কিছু না।
- কিছু না মানে। এটাই তো বলতে চাচ্ছো যে এতদিন কিভাবে থাকতে পারলাম তোমার সাথে কথা না বলে? ঐটা তোমার না জানলেও হবে ঠিক আছে। এখন বলো তোমার এই অবস্থা কি করে হলো?
- বাদ দেও।
- না দিবো না। বলো।
- অফিস থেকে বাসায় আসার পথে রাস্তা পাড় হতে গিয়ে সি.এন.জি'র সাথে ধাক্কা লাগে। পরে পড়ে যাই আর পায়ের উপর দিয়ে সি.এন.জি গেছে। এইটুকুই।
- কেনো ফুট ওভার ব্রিজ কেনো দিয়েছে?
- আহা তাড়া-তাড়ি আসবো বলে ফুট ওভার ব্রিজে উঠিনি।
- জীবনের চেয়ে কি সময়ের মূল্য অনেক বেশি? এর কারণেই তো মানুষ রোড এক্সিডেন্ট করে। আল্লাহ্ রহমতে বেশি কিছু হয়নি। এর চেয়েও ভয়ানকক অবস্থা হতে পারতো কিন্তু এটা জানো?
- হ্যাঁ জানি।
.
তখনই হৃদয়ের ছোট বোন এসে বলছে।
- ভাইয়া ভাইয়া কে জানি তোমায় দেখতে এসেছে?
- আবার কে আসবে? যে আসার সে তো এসেছেই। <হেসে বললো কথাটি>
- দেখো কে এসেছে।
.
তাদেরকেও দেখবে সেটা ভাবেনি হৃদয়। আদ্রিতার বাবা-মা এসেছেন। আদ্রিতা ভয়ে কাঁপছিলো। কিন্তু কিভাবে কি হলো সেটাই ভাবছে। একটু পর হৃদয়ের মা এসে বলে -
' গতকাল বিকেলে আদ্রিতার নম্বরে কল দেই পরে ওর আম্মু ধরে। তখন তোমাদের কথা বললাম। তারা আজই আসতেন কিন্তু গতকাল সন্ধ্যায় তোর এরকম দূর্ঘটনায় আর তোকে বলা হয়নি কিছুই।'
আর একটা খুশির সংবাদ আছে যে আজই তোমাদের বিবাহ। আমরা সবাই মেনে নিয়েছি তোমাদের সম্পর্ক। সন্ধ্যার পর কাজী আসবে তখনই তোমাদের বিবাহ হবে। তুই সুস্থ হয়ে উঠ পরে সবাইকে জানিয়ে দেবো। এখন তোমরা কথা বলো আমরা সবকিছু ম্যানেজ করি। পরে সবাই চলে যায়। হৃদয় এবং আদ্রিতা একা বসে আছে।
.
হৃদয় বলছে কিভাবে সম্ভব? কখনো ভাবিওনি যে এভাবে এত বড় একটা কাজ হবে। অন্যদিকে আদ্রিতা তার কথা শুনে হাসছে।
- একটু আগেই না ভয়ে কাঁপছিলে? এখন আবার হাসছো?
- তাহলে কি করবো কাঁদবো?
- জ্বি না। আর কাঁদতে হবে না। আর আমাকেও কাঁদানো লাগবে না।
- আচ্ছা ঠিক আছে।
- তুমি কি আগে থেকেই জানতে?
- নাহ। আমি তো কিছুই জানিনা। আমি তো একা আসছি। বাবা-মা কখন আসলো?
- ওহহহ।
- হুমম।
- আচ্ছা একটা চিমটি কাটো তো আমার হাতে।
- কেনো?
- আসলেই কি এইসব স্বপ্ন দেখছি নাকি বাস্তব?
- হাহাহা। ঠিক আছে এই নাই চিমটি কাটলাম।
- ওউ। এত জোড়ে কেউ চিমটি কাটে?
- আচ্ছা বাবা সরি। আঁদর করে দেবো?
- দেও।
- ইশশশ। সন্ধ্যার পরে। আগে বিয়েটা হউক তারপর যতখুশি নিও।
.
কি ভাবছেন??? আসলেই এটাই ঠিক। ধর্যের ফল ভালো হয়। আর যেটা ভাগ্যে লেখা আছে সেটাই হবে। মাঝে মাঝে ভাগ্যটাকেও নিজের করে নিয়ে হয়। আপনাদের সবার দাওয়াত রইলো তাদের বিয়েতে। এবং দোয়া করবেন তাদের জন্য।
.
.
লেখাঃ হৃদয় নাদিম
.
(সমাপ্ত)

Comments
Post a Comment