✴স্বপ্নময়ী✴ (১০ম পর্ব)


ভোর সকালে ঘুম থেকে উঠে তিন্নিদের বাসার সামনে যাওয়াটা হৃদয়ের রুটিন হয়ে যায়। হৃদয় নিয়মিত নামাজ পড়ার চেষ্টা করতো। আল্লাহ্‌র আদেশ নির্দেশ মেনে চলতো। সকালে ঘুম থেকে উঠে ফজরের নামাজ আদায় করে। তারপর তিন্নিদের বাসার সামনে ঘুরা-ঘুরি করা। শুধু মাত্র একটা পলক তিন্নিকে দেখবার জন্য।
.
হৃদয়ের দেখা দেখি তিন্নিও নিয়মিত নামাজ পড়তো। একজনকে দেখে যদি অন্যকেউ ভাল হতে পারে তাহলে সেটা অনেক ভাল লাগে। যেমনটা ভাল লাগছে হৃদয়ের। এইভাবেই আস্তে আস্তে কেটে যায় তাদের স্কুল জীবন। এস.এস.সি পরিক্ষার শেষে হৃদয় চলে আসে তার গ্রামের বাড়ি। তখন তিন্নির সাথে সরাসরি দেখা হতো না কিন্তু ফোনে প্রায়ই সময় কথা হতো। এস.এস.সি পরিক্ষার পরে তিন্নিকে বাসা থেকে নিজস্ব ফোন ইউজ করার অধিকার দেয়।
.
এরপর থেকেই সবসময় ফোনে কথা হতো। কিন্তু দূরত্বটাই তাদের ভালবাসায় একটা সময় বাঁধা হয়ে দাঁড়ায়। ফোনে কথা বলতে বলতে এক সময় তিন্নি তার মায়ের কাছে ধরা পড়ে যায়। এরপর থেকেই তার ফোন ইউজ করা বন্ধ হয়ে যায়। লুকিয়ে কথা হতো তাদের। সপ্তাহে ১ দিন কথা বলতো। এভাবে কিছুদিনের মধ্যে তাদের দূরত্বটা আরো বেড়ে যায়। মাসে একবার কথা হচ্ছে তাদের। একটা সময় একেবারেই কথা বলা বন্ধ করে দেয় তিন্নি।
.
কিন্তু এর বিশেষ কারণটি এখন পর্যন্তও জানতো না হৃদয়। কেনো এমনটা করেছিলো। আসলেই কি দূরত্বটাই ভালবাসাকে শেষ করে ফেলে? নাকি এর অন্য কোনো কারণ আছে। তা জানতে হলে বুঝতে হবে নিজেদের মন। কি চাচ্ছে মন! কিভাবে খুশি রাখবে এরকমই কিছু। তবে ভালবাসায় কোনো দূরত্বই বাঁধা হয়ে দাঁড়ায় না যদি সেটা সত্যি কারের ভালবাসা হয়ে থাকে।
.
দু'বছর হয়ে গেলো হৃদয় এবং তিন্নির মাঝে কথা হয়নি। হৃদয় জানেনা কি ভুলে তিন্নি তাকে দূরে ফেলে দেয়। এখন হৃদয় তার ব্যবসার কাজেই নিজেকে ব্যস্ততার মাঝে ডুবিয়ে রাখে। আর যখনই তিন্নির কথা মনে পড়ে তখনই নিকোটিনের ধুয়া উড়িয়ে নিজের কষ্ট গুলো চেপে রাখে। আসলেই কি হৃদয় এটা ঠিক করছে? না একদমই ভুল করছে। কারণ জীবন কারো জন্য থেমে থাকেনা। যতদিন বেঁচে থাকতে হবে ততদিন কোনো না কোনো বাঁধা আসবেই। সে বাঁধা কাটিয়ে নিজেকে সুন্দর করে গড়ে তোলাই বুদ্ধিমানের কাজ।
.
তবে ভালবাসা হচ্ছে কখনো খারাপ কাজ থেকে ভাল পথে ফিরিয়ে আনা। আবার কখনো এই ভালবাসাই জগন্য খারাপ কাজে প্রতিক্ত হয়ে উঠে। যার একমাত্র কারণ হলো সত্যি কারের ভালবাসার মানুষটিকে যখন হাঁড়িয়ে ফেলে। তখনই অনেকেই বেছে নেয় স্মোকিং। নিকোটিনের ধোয়ায় নিজের ঠোঁট পুড়ছে আর সে সাথে পুড়ছে বুকের ভেতরের জমানো হাজারো স্বপ্ন গুলো।
.
এইবলে হৃদয় তার কথা বন্ধ করে। পিয়াস তার কথা গুলো মুগ্ধ ভাবে শুনে। পিয়াসের চোখের কোণে পানি টুপটুপ করছিলো। চোখ বুঝলেই যেনো বৃষ্টি বয়ে যাবে। আর হৃদয় তো কাঁদছেই কথা তিন্নির কথা যতবার বলেছে ততোবারই নিজের শরীরে আঘাত করেছে। না যত চেষ্টাই করুক না কেনো তিন্নি কে ভুলার জন্য। হৃদয় তাকে ভুলতে পারেনি। আর পারবেও না। শুধু শেষ হয়ে গেলো মনে রাঙানো হাজারো স্বপ্নগুলো।
.
- পিয়াস অনেক রাত হয়ে গেছে। এইবার চল ঘুমাতে যাই।
- হ্যাঁ আসলেই অনেক রাত হয়ে গেছে।

কথাটি বলেই পিয়াস উঠে দাঁড়ায়। হৃদয় তখনই সিগারেট টানছিলো। পিয়াস তাকে থামায়নি। থামায়নি এর কারণেই যে পুরোনো স্মৃতি গুলো মনে পড়ে যায়। এরকম স্মৃতি মনে পড়ে গেলে বুকের ভেতর কি যে যন্ত্রনা শুরু হয় তা শুধু মাত্র তারাই জানতে পারবে যারা এরকম কোনো পরিস্থিতিতে পড়েছে।
.
- হৃদয় এইবার উঠ দোস্ত।
- হুমম দোস্ত উঠছি।
- শোন তিন্নির কথা আর একটুও মনে করবিনা।
- করতে তো চাইনা রে। কিন্তু মনে পড়ে যায়।
- আচ্ছা বাদ দে। এইবার রুমে চল। ঘুমাতে হবে।
- হুমম চল তাহলে।
.
ছাদ থেকে নিচে নামে। রুমের মধ্যে যায়। বিছানায় শুইয়ে পড়তেই ঘুমিয়ে পড়ে হৃদয়। কিন্তু পিয়াসের ঘুম কোথায় যেনো হারিয়ে যায়। হৃদয়ের কথা শুনে খুব কষ্ট পায়। কিন্তু পিয়াস জানে তিন্নি কেনো হৃদয়ের সাথে যোগাযোগ রাখেনি।
.
কারণটা হলো তিন্নি তার মা-বাবাকে তার পছন্দের মানুষটির কথা জানায়। কিন্তু তারা মেনে নেয়নি। তিন্নির মুখে কথাটি শুনবার পর তার মা-বাবা তাকে অনেক মারধোর করে। একা ঘরে বন্দি করে রাখে। কারো সাথেই কোনো যোগাযোগ করতে দেয়নি। কিছুদিনের মধ্যেই তিন্নিকে জোর করে বিয়ে দিয়ে দেয়।
.
অনেক মা-বাবারা এই একটা ভুলই করে থাকেন। তারা তাদের ভালোর জন্য তাদের সন্তানের মনের সুখ কেড়ে নেয়। বিয়ের কিছুদিন পরেই জানতে পারে তিন্নি আর নেই। সবাইকে ছেড়ে চলে গেছে বহুদূরে। তিন্নি পারছিলো না হৃদয়কে ছেড়ে অন্যকাউকে নিয়ে ঘর বাধতে। তাই সে একেবারে পৃথিবী থেকেই বিদায় নিয়ে নেয়।
.
পিয়াসের বাসার কাছেই তিন্নিদের বাসা। যার কারণে পিয়াস সবকিছুই জানতো। কিন্তু হৃদয়কে কিছু বলেনি কারণ যদি হৃদয় ও এরকম একটা ভুল করে ফেলে এই ভয়ে। তিন্নির মৃত্যুর একমাত্র কারণ হলো তার মা-বাবা। যদি তারা সেইদিন তিন্নির বলা কথাটি মেনে নিতেন তাহলে আর এরকমটা হতো না।
.
পিয়াসের চোখ দিয়ে পানি ঝড়ছিলো কথা গুলো মনে করে। হৃদয় ঘুমাচ্ছিলো। পিয়াসও কিছুক্ষণ পর ঘুমিয়ে যায়। ঘুম থেকে উঠে ভোর সকালে। হৃদয় ফজরের নামাজ পড়তে যায়। পিয়াসও গেলো সাথে। নামাজ পড়ে এসে আবার ঘুমিয়ে পড়ে। ঘুম থেকে উঠে হৃদয় একদমই অন্যরকম হয়ে গেলো। কাউকেই বুঝতে দেয়না তার বুকের মধ্যে লুকানো কষ্টাকে। নিজে একা একাই চেপে রেখেছে মনের ভেতর।
.
এরকমটা মানুষ কিভাবে থাকতে পারে? হাসির মধ্যেও লুকিয়ে থাকা কষ্টটা কেউ দেখতে বা বুঝতে পারেনা। আর সবাই হাজারটা কষ্ট বুকে চেপে রেখে হাসতেও পারেনা।
.
.
(চলবে)

Comments