চাকরি নিয়ে নানা ধরনের হতাশায় ভুগতে হচ্ছে প্রায় ৯০ % মানুষের। তাদের মধ্যে নারী ও পুরুষ উভয় ব্যক্তিই রয়েছে। এক কথায় চাকরি পাওয়া হচ্ছে সোনার ডিম অর্জন করার মতই। কিন্তু এই সোনার ডিম পাওয়াটা কতজন ব্যক্তির ভাগ্যে লেখা আছে। কেউ একের পর এক ইন্টারভিউ দিয়েও তার ভাগ্যে লিখতে পারছেনা আবার কেউ ঘরে বসে থেকেও চাকরি পেয়ে যাচ্ছে। এর প্রধানত একটাই কারণ রয়েছে যেমনঃ অনেকে তাদের চাচা-মামা'দের মাধ্যমে চাকরি পেয়ে যাচ্ছে। অথচ যাদের চাচা-মামা নেই তাদের জন্য খুবই হতাশাজনক একটা বিষয়। তবে তবুও চাকরির পিছনে ছুটে চলছে কিছু কিছু মানুষ একটাই আশায় সেটা হলো। একদিন না একদিন কষ্টের ফল আসবেই। কিন্তু সেটা কী আধোও সম্ভব?
রাফসান'কে উৎসর্গ করে আজকের এই গল্পটি। রাফসান গ্রামের ছেলে। তিনি ভাবতো ঢাকা শহরে এসে হয়তো ভাল একটা চাকরিতে এটেন্ড করতে পারবে। ঢাকায় তার একটা দুঃসম্পর্কের ভাইয়ের সাথে উঠেছে। রাফসান আগে থাকতো অন্য একটা পরিবেশে কিন্তু এখন সে ভিন্ন একটা পরিবেশে বসবাস করছে। অনেকটা সময়ের ব্যবধানে তিনি নতুন পরিবেশে থাকার জন্য সক্ষম হয়েছে। ছুটছে চাকরির জন্য বিভিন্ন কোম্পানিতে। কিন্তু কোনো কিছুতেই যেনো খুঁজে পাচ্ছিলো না সোনার ডিমটা। তবুও সে আশা ছাড়েনি চেষ্টা চালিয়েই যাচ্ছিলো প্রতিনিয়ত।
সেইদিন ছিলো তার ১৪ নম্বর ইন্টারভিউ। কাগজ পত্র ঠিক করে একটা ফাইলে রেখে দিলো। অপেক্ষায় ছিল কখন রাত শেষ হয়ে ভোর হবে। ঘুমটাও যেনো চোখ থেকে দূরে হারিয়ে গেছে। দু'চোখের পাতা যেনো লাগতেই চাচ্ছিলো না। একটা মানুষ কতটা ডিপ্রেশনে থাকলে এরকম হয় সেটা আমাদের মধ্যে যার এরকম কিছু ঘটেছে তারাই বলতে পারবে। রাত পেরিয়ে সকাল হয়েছে রাফসান ইন্টারভিউতে যাওয়ার জন্য তৈরী হচ্ছিলো। এমন সময় তার মোবাইলে একটা কল আসে অচেনা নম্বর থেকে। রাফসান কলটা পিক করে।
- হ্যালো আসসালামু ওয়ালাইকুম।
- ওয়ালাইকুম আসসালাম। রাফসান বলছেন?
- জ্বি আমি রাফসান। কে বলছেন?
- একটা ব্লাড গ্রুপ থেকে আপনার কন্টাক্ট নম্বরটি কালেক্ট করেছি। আপনার রক্তের গ্রুপ তো ও (O)- নেগেটিভ?
- জ্বি আমার ব্লাড গ্রুপ O(-)।
- আমার আম্মার অপারেশন ১০ টায়। আপনি কি দিতে পারবেন দয়া করে?
- সকাল দশটায়?
- হ্যাঁ ভাইয়া। তিন ব্যাগ লাগবে দুই ব্যাগ জোহাড় করতে পেরেছি। আর এক ব্যাগ দরকার। যদি আপনি দিতেন তাহলে আমার আম্মাকে বাঁচানো সম্ভব দয়া করে না করবেন না।
- আচ্ছা কোন হসপিটালে আসতে হবে?
- ঢাকা মেডিকেল এ আছি। দয়াকরে একটু আসেন প্লিজ।
- আচ্ছা আসছি আমি।
রাফসান কথা শেষ করে কলটা রেখে দেয়। এবং সে ভাবছিলো তার আজ ইন্টারভিউ আর অন্যদিকে কোনো এক মা'য়ের অপারেশন। যদি রক্ত মেনেজ না হয় তাহলে মা'য়ের অপারেশন হবে না। আর ও নেগেটিভ রক্তটা শতকরা ০৫ % মানুষের রয়েছে। যদি রক্ত দিতে যায় তাহলে ইন্টারভিউতে যেতে পারবে না। চাকরিটাও খুব বেশি প্রয়োজন রাফসানের। কিন্তু চাকরিটা যে রাফসান পাবে তার কী গ্যারান্টি। কিন্তু যদি রক্তটা ঐ মা'য়ের জন্য দেওয়া হয় তাহলে হয়তো তাকে বাঁচানো সম্ভব। তা ভেবেই রাফসান বাসা থেকে বের হয় ৮ টার সময়। হসপিটালে পৌঁছতে সময় লেগে যায় প্রায় দেড় ঘন্টার মত। রাস্তায় অনেকটা পথ জ্যামে পারি দিয়েও হসপিটালে গিয়ে পৌঁছে। এর মধ্যে রাফসানের মোবাইলে কল আসে। মোবাইলটি পকেট থেকে বের করতেই দেখতে পায় তার বাবার নামটি ভেসে উঠেছে। কলটি পিক করে রাফসান।
- আসসালামু ওয়ালাইকুম আব্বা। কেমন আছেন?
- আল্লাহ্র রহমতে ভাল আছি বাজান। তুই কেমন আছিসরে বাবা?
- জ্বি আব্বা। আলহামদুলিল্লাহ্ ভাল আছি।
- বাবা। চাকরি বাকরি কিছু হলো? সামিররের সেমিষ্টার চলে এসেছে এই দিকে তোর মা'য়ের শরীরটাও বেশি ভালো না। আমিও আর পারছি না। জায়গা সম্পদ যা ছিলো তা সব বিক্রি করে তো তোর পড়া-লেখার পিছনে খরচ করে ফেলেছি। এখন শুধু এই ছোট বাসাটুকুই রয়েছে।
- আব্বা আপনি চিন্তা করবেন না। ইনশাআল্লাহ্ কিছু একটা হয়ে যাবে। আর সামিরের সেমিষ্টার ফি জমা দেওয়ার শেষ তারিখ কবে?
- আগামীকাল।
- চিন্তা করবেন আমি আজ রাতে বিকাশে টাকা পাঠিয়ে দিবো। আম্মাকে আমার সালাম জানাইয়েন।
রাফসানের চোখে পানি এসে পরে তার আব্বার সাথে কথা বলার সময়। হ্যাঁ ঠিকই বলেছেন গ্রামে জমি যা ছিলো সবই বিক্রি করে রাফসানের পড়া-লেখার জন্য খরচ করেছেন। কিন্তু এত পড়া-লেখা করেও তো ভাল একটা চাকরি পাচ্ছে না। হসপিটালের সামনে গিয়ে ঐ নম্বরে কল দেয় রাফসান। রাফসানকে নিচ থেকে নিয়ে যায় লোকটি। এবং রক্ত দেয় রাফসান। ঠিক সকাল ১০ টার সময় অপারেশন থিয়েটার এ নিয়ে তাকে। রাফসান অপেক্ষা করছিলো বসে তাদের সাথে। অপারেশন হয়েছে এবং চিকিৎসকের কাছ থেকে জানতে পারে ঠিক সময় মত রক্ত না পেলে রোগীকে বাঁচানো সম্ভব ছিলো না।
- অনেক অনেক ধন্যবাদ ভাই আপনাকে। আপনি না রক্ত দিলে হয়তো আমার আম্মা কে হারিয়ে ফেলতাম। আপনার এই উপকারিতার ঋণ কখনো শোধ করতে পারবো না ভাই।
- এভাবে বলে ছোট করবেন না ভাই। আপনার আম্মা না শুধু আমি আমার আম্মার কথা স্মরণ করেই এসেছি। এমনতো হতে পারতো এই সমস্যার মুখোমুখি আমাকেও পরতে হতো তখন কী চুপ করে বসে থাকতাম?
- ভাই আপনি অনেক ভাল। আসেন আপনাকে এগিয়ে দিয়ে আসি।
- জ্বি ভাই চলুন। আর আন্টির সুস্থতার খবর আমাকে জানাবেন।
- আচ্ছা ভাই অবশ্যই।
হসপিটালের নিচ পর্যন্ত ঐ ভাইটি আসে রাফসানের সাথে। আর রাফসান তখন মনে মনে খুশি হলেও তার মাথার মধ্যে সে ডিপ্রেশন গুলো ঘুরপাক খাচ্ছিলো। অনেকটা পথ পর্যন্ত এগিয়ে দেয় তাকে। এবং যাওয়ার সময় সে লোকটি রাফসানের হাতে কিছু গুঁজে দেয়। রাফসান হাত মেলে দেখতে পায়। এবং তাকে বলে।
- এটার মানে বুঝলাম না ভাই।
- কষ্ট করে আসছেন। এটা রাখেন ভাই খুশি হবো।
- রাফসান হাসি দিয়ে একটা বড় নিশ্বাস ফেলে বলে। ভাই আমি আপনাকে আগেই বলেছি আমি কেনো এসেছি। আর আপনি এই টাকা দিয়ে আমাকে অপমান করছেন। আমি তো টাকা পাওয়ার লোভে আসিনি এইখানে। শুনেন ভাই আপনি যদি ভাবেন এক হাজার টাকার মাধ্যমে আপনি রক্ত কিনে নিয়েছেন সেটা ভুল। আল্লাহ্ সৃষ্টি করেছেন আমাদের। আমাদের শরীরের সব কিছুই তার সৃষ্টির। আর আল্লাহ্র সৃষ্টির রক্তের জন্য যদি আমি আপনার কাছ থেকে টাকা নেই। আল্লাহ্ আমাকে কখনো মাফ করবেন। আপনি এক কাজ করেন এই টাকাটা নিয়ে আপনার আম্মার জন্য কিছু কিনে নিয়ে যান। তাতে আমি অনেক খুশি হবো।
- ভাই আপনার কথায় আমি মুগ্ধ। কিন্তু আপনার মত করে সবাই তা ভাবে না। যদি মানুষের বিপদে মানুষ তাদের হাত বাড়িয়ে দিতো তাহলে আর দুনিয়াতে কোনো খারাপ কিছু ঘটতো না।
- মানুষের বিপদে এখনো অনেক মানুষ হাত বাড়িয়ে দেয়। কিছু কিছু মানুষের জন্য সবাইকে ছোট বলা যায় না। আচ্ছা ভাই আমি আসি। আর আন্টিকে আমার সালাম জানাবেন। এবং একটু দোয়া করবেন আমার জন্য।
রাফসান কথাটি বলে চলে আসে এবং বাসায় এসে পৌঁছে। বাসায় আসতেই ফ্লাটের বড় ভাইয়ের সাথে কথোপকথন হয় রাফসানের।
- রাফসান ইন্টারভিউ কেমন হলো তোর?
- ভাল। কিন্তু ভাল হলেই কী আর চাকরি হবে?
- এইবার তাহলে একটু অন্য কিছু চেষ্টা কর। অনেক তো ইন্টারভিউ দিলি।
- কি চেষ্টা করবো ভাই? কোনো কিছুই তো খুঁজে পাচ্ছিনা।
- শোন আমার এক ছোট ভাই আছে মার্কেটে চাকরি করে। তুই একবার ওর সাথে গিয়ে দেখতে পারিস।
- হ্যাঁ ভাই। ঠিক আছে যাবো আমি।
- আচ্ছা আমি ওর সাথে কথা বলে দেখি।
- আচ্ছা।
- এখন যা ফ্রেশ হয়ে নে।
- ভাই।
- কিছু বলবি রাফসান?
- হ্যাঁ ভাই। আমার কিছু টাকা দরকার।
- কত টাকা?
- হাজার তিন এক হলেই হবে।
- আচ্ছা ঠিক আছে নিয়ে যাস। এখন দিবো?
- বিকেলে দিলেই হবে।
- আচ্ছা ভাই ধন্যবাদ।
বেলা ১২ টা বাজে তখন। সকালের নাস্তাটাও হয়নি। নাস্তার টাকা বাঁচিয়ে হসপিটালে গিয়েছি। তাই নাস্তা করতে পারিনি। একেবারে দুপুরের খাবার খেয়ে ফেলবো। বড় ভাইয়ের থেকে তিন হাজার টাকা নিয়ে সামিরের সেমিষ্টার ফি এর জন্য পাঠিয়ে দিলাম। আব্বাকে কল দিয়ে জিজ্ঞাসা করলাম টাকা পেয়েছে কিনা। আব্বা খুব খুশি হয় টাকাটা পেয়ে। রাতে বাসায় এসে জানতে পারি আগামীকাল থেকেই মার্কেটের সেল্সমেন হিসেবে এটেন্ড করবো। প্রথমত সেলারি খুবই কম ছিলো। এভাবেই চলতে থাকে।
প্রায় ছয় মাস এই জবটা করি। আসতে আসতে প্রমোসন হচ্ছিলো। তখন সেলারি ১৫ হাজার হয়েছে। একদিন দোকানের মালিকের সাথে অনেকখন কথা বলি। আমার পড়া-শুনার ব্যাপারেও বলি। সে তখন বলে।
- রাফসান তোমার তো বিবিএ কমপ্লিট হয়েছে। তুমি তো চাইলে এর থেকেও ভাল কোনো জব করতে পারতে। তোমার কী এই সেলারিতে হচ্ছে?
- ভাইয়া। অনেক ঘুরা-ঘুরি করেছি। অনেক ইন্টারভিউ দিয়েছি কিন্তু কোনো লাভ হয়নি। আসলে সবার ভাগ্য যে ভাল হয় তা কিন্তু নয়। আর সর্বশেষ কথা হলো আমার তো চাচা-মামার জোড় নেই।
- হাহাহা। রাফসান তোমাকে কিন্তু আমি অনেক পছন্দ করি। আর তোমার জন্য একটা খুশির সংবাদও আছে।
- সেটা কী ভাইয়া?
- আমি প্লানিং করেছি আর একটা শো রুম খুলবো। আর সেটাতে তোমাকে ম্যানেজার হিসাবে রাখবো। কারণ আমার মনে হয় তুমি এই কাজ ভাল ভাবেই করবে।
- জ্বি ভাই। অনেক খুশি হলাম। তবে আমি কী পারবো?
- ইনশাআল্লাহ্। আমার মনে হয় পারবে। আর একটা কথা মনে রাখবে কোনো কাজকেই ছোট মনে করবে না। সব কাজই সমান।
- জ্বি ভাই।
- আর একটি কথা কি জানো? আমি তোমাকে আর একটা পরিচয়ে চিনি। আগে চিনতাম না তবে রিশুর মাধ্যমে আবার চিনলাম।
- রিশু কে ভাইয়া?
- রিশুকে চিনো না? তাহলে শুনো তুমি একবার রক্ত দিতে যাও কোনো মহিলাকে? যে তোমাকে কল দিয়েছিলো তার নামই রিশু। আর রিশু হচ্ছে আমার খালাতো ভাই। মানে বুঝেছো তুমি আমার আন্টিকে রক্ত দিয়েছিলে। আর তোমার ব্যাপারে আমাকে রিশু সব বলেছিলো যেইদিন তোমার কথা রিশুকে বলি।
- ওহ আচ্ছা। কেমন আছেন আন্টি?
- হ্যাঁ ভাল আছেন। রিশু খুব খুশি হয়েছে জেনে তুমি আমাদের দোকানে জব করো।
- কিন্তু তাকে তো দেখলাম না কখনো আসতে।
- রিশু এখন অস্ট্রেলিয়াতে আছে। তোমার সাথে দেখা করার খুব ইচ্ছে ওর। হয়তো দেশে আসলে তোমার সাথে দেখা করবে। আর একটি কথা। নতুন যে শো রুমটা চালু করবো ভাবছি সেটার সম্পূর্ণ রিশুর জন্যই। রিশুই বলেছে নতুন একটা শো-রুম ওপেন করতে আর সেটাতে যেনো তোমাকে ম্যানেজার হিসাবে রাখি।
- ভাই কি বলে যে ধন্যবাদ দিবো।
- ধন্যবাদ নয়। আসলে ভাল মানুষের জন্য সবারই কোনো না ভাল দিক আসে। সেটা শুধু সময়ের জন্য অপেক্ষা করে।
- ভাই দোয়া করবেন। যেনো জীবনে বড় হতে পারি।
- অবশ্যই। তোমার মত ভাল মানুষের জন্য সবাই দোয়া করবেন। আর আমি চাই তোমাকে কিছু একটা করে দিতে। যাতে তুমি ফিউচারে কিছু একটা করতে পারো।
কী ভাবছেন সবই খুব সহজে ঘটে গেলো? ঠিক তা না। জীবনে স্ট্রাগল করতে করতেই এই পর্যায় আসতে পেরেছি। আসলে আল্লাহ্ সবাইকে প্রথমত পরিক্ষা করেন। যদি আপনি পরিক্ষায় পাশ করেন তাহলে অবশ্যই ফলটাও খুব মিষ্টি ভাবে গ্রহণ করতে পারবেন। দুই বছর হয়ে যায় এখন রাফসান নিজেই একটা শো-রুম চালু করেছেন। এবং জীবনে কিছু করতে হলে শুধু মাত্র সৎ হওয়া জরুরি। অসৎ পথে আপনি যদি কিছু করেন সেটা বেশিদিন আপনার কাছে থাকবে না। আর কোন কাজই ছোট নয়। যে ছোট মনে করে তার জন্য জীবনটা অনেক কষ্টকর।
রাফসান এখন তার পরিবারকে নিয়ে আসে। একইসাথে বসবাস করছে। কিন্তু তার মধ্যে সততা এখনো রয়েছে। " জীবনে অনেক কঠিন পরিক্ষার মুখোমুখি হতে হবে আর সে কঠিন পরিক্ষায় যদি জয় লাভ করেন তাহলে অবশ্যই আপনি সাকসেসফুল। "
''
(হৃদয় নাদিম)
Comments
Post a Comment